(প্রযুক্তি প্রতিদিন) টেস্টটিউব শিশুর জনক নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্যার রবার্ট এডওয়ার্ড গত বুধবার মারা গেছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। টেস্টটিউবে শিশুর জন্মদান পদ্ধতি কৃত্রিম নিষেকক্রিয়া বা আইভিএফ নিয়ে স্যার এডওয়ার্ড কাজ শুরু করেন পাঁচ দশকের বেশি সময় আগে। তাঁর গবেষণার সফলতাস্বরূপ তাঁর হাত ধরেই ১৯৭৮ সালে পৃথিবীর মুখ দেখে বিশ্বের প্রথম টেস্টটিউব শিশু লুইস ব্রাউন। এই অবদানের জন্য ২০১০ সালে বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান তিনি। এই গবেষণায় তাঁর সহযোগী ছিলেন প্যাট্রিক স্টেপটোয়ে।
রবার্ট এডওয়ার্ডের জন্ম ১৯২৫ সালে যুক্তরাজ্যের ইয়র্কশায়ারের একটি শ্রমজীবী পরিবারে। তিনি শুরুতে কৃষিবিজ্ঞান এবং পরে প্রাণীর বংশগতিবিষয়ক বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন। প্রাথমিক পর্যায়ের গবেষণায় তিনি দেখতে পান, টেস্টটিউবের মধ্যে খরগোশের ডিম্বকোষ ও শুক্রাণু নিষেক করা সম্ভব। এই পদ্ধতিই তিনি পরবর্তী সময়ে মানুষের জন্য কাজে লাগানোর চেষ্টায় সফল হন। ১৯৬৮ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে তিনি প্রথম প্রত্যক্ষ করেন গর্ভাশয়ের বাইরে টেস্টটিউবে মানুষের ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর কৃত্রিম মিলনের পাঁচ থেকে ছয় দিনের মাথায় ভ্রূণের জন্ম হচ্ছে।
বর্ণাঢ্য জীবন
এডওয়ার্ডস ১৯২৫ সালে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারে জন্মগ্রহণ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন। পরে জীববিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন বাঙ্গোরে ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫৫ সালে তিনি এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি লাভ করার পর লন্ডনের মেডিক্যাল রিচার্স ইনস্টিটিউটে গবেষক হিসেবে যোগ দেন। এডওয়ার্ডস ১৯৬০-এর দশকে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে গবেষণার সময় অনুবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে জরায়ুর বাইরে ভ্রƒণ নিষিক্ত হওয়ার ঘটনা প্রথম প্রত্যক্ষ করেন। ওই ঘটনাকে ‘অত্যাশ্চর্য’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন এডওয়ার্ডস। এরপর তিনি আইভিএফ পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য দীর্ঘ দিন নিরলসভাবে কাজ করেছেন। গবেষণায় তার সাথী ছিলেন প্যাট্রিক স্টেপটো। কৃত্রিম গর্ভধারণের পদ্ধতি আবিষ্কারের প্রচেষ্টার কারণে তারা বিভিন্ন সময় ক্যাথলিক চার্চসহ বিরোধীপক্ষের কঠোর সমালোচনার মুখোমুখি হন। ১৯৬৩ সালে রবার্ট এডওয়ার্ডস ক্যামব্্িরজ ইউনিভার্সিটিতে যোগ দিয়ে সহকর্মী প্যাট্রিক স্টেপটোকে সঙ্গী করে বাউরন হল নামে একটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানেই স্থাপিত হয় বিশ্বের প্রথম আইভিএফ সেন্টার।
১৯৭৮ সালের ২৫ জুলাই এই দুই বিজ্ঞানীর প্রচেষ্টা সাফল্যের মুখ দেখে। ম্যানচেস্টারের ওল্ডহাম জেনারেল হসপিটালে জন্ম নেয় বিশ্বের প্রথম টেস্টটিউব শিশু লুইস ব্রাউন। তার পর থেকে এডওয়ার্ডস ভিআইএফ পদ্ধতিকে আরো কার্যকর ও উন্নত করার চেষ্টা চালিয়ে যান। সন্তান ধারণে অক্ষম নারীদের জন্য খুলে যায় আলোকিত এক অধ্যায়।
নোবেল স্বীকৃতি
টেস্টটিউবে কৃত্রিম উপায়ে গর্ভধারণ পদ্ধতি বা ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (আইভিএফ) উদ্ভাবনের স্বীকৃতি হিসেবে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রবার্ট এডওয়ার্ডস চলতি বছর চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। সুইডিশ ক্যারলিনস্কা ইনস্টিটিউট সম্প্রতি সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে সংবাদ সম্মেলন করে এই পুরস্কারের জন্য অধ্যাপক এডওয়ার্ডসের নাম ঘোষণা করে। আইভিএফ প্রযুক্তিতে টেস্টটিউব শিশুর জন্ম দেয়ার বিষয়টিকে ‘আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের মাইলফলক’ বলে অভিহিত করেছে নোবেল পুরস্কার কমিটি। এই কমিটি জানায়, বিশ্বের ১০ শতাংশেরও বেশি দম্পতি বন্ধ্যা। আগে এই দম্পতিরা সারা জীবন অস্বাভাবিক মানসিক হতাশায় ভুগতেন। তাদের জন্য তেমন কার্যকর ওষুধও ছিল না। কিন্তু আইভিএফ প্রযুক্তি সফল হওয়ার পর সেই পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। এখন এই প্রযুক্তির মাধ্যমে সন্তান নেয়া একটি প্রতিষ্ঠিত ও কার্যকর পদ্ধতি বলে বিবেচিত।
এডওয়ার্ড ও তার তৈরী টেস্টটিউব বেবি
নোবেল কমিটি রবার্ট এডওয়ার্ডকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার কারণ ব্যাখ্যা করে বলেছে, তার উদ্ভাবন গর্ভধারণে অক্ষমতা দূর করার ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রেখেছে। সারা বিশ্বে ১০ শতাংশেরও বেশি দম্পতি এ সন্তানহীনতার সমস্যায় ভুগছেন। নোবেল কমিটি বলেছে, নারীর জরায়ুর বাইরে টেস্টটিউবে কৃত্রিম উপায়ে ডিম্বাণু নিষিক্ত করার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি উদ্ভাবন করে জটিল একটি সমস্যার সমাধান করতে পেরেছেন রবার্ট এডওয়ার্ডস। মানবসভ্যতায় তার অবদান অসাধারণ। ১৯৫০-এর দশক থেকে তার উদ্ভাবিত ইনভাইট্রো ফার্টিলাইজেশন (আইভিএফ) নামের কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় লাখ সন্তানের জন্ম হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় সন্তান জন্মদানে অক্ষম দম্পতিরা দেখেছেন সন্তানের মুখ। হাসিতে ভরে গেছে তাদের ঘর। ল্যাবরেটরিতে প্রথমে পুরুষের দেহ থেকে শুক্রাণু ও নারীর দেহ থেকে ডিম্বাণু নিয়ে তা টেস্টটিউবে নিষিক্ত করানো হয়। এরপর তা প্রতিস্থাপন করা হয় মায়ের গর্ভাশয়ে। সেখানে নিষিক্ত ডিম্বাণুতে স্বাভাবিক বৃদ্ধি হতে থাকে শুক্রাণুর। এ প্রক্রিয়ায় জন্ম নেয়া শিশুকে অনেকেই টেস্টটিউব বেবি আখ্যা দিয়ে থাকেন। নোবেল কমিটি রবার্ট এডওয়ার্ডসের নাম ঘোষণা করে বলেছেÑ বিশ্বের প্রায় ১০ শতাংশ দম্পতি সন্তান জন্মদানে অক্ষম। রবার্টের আবিষ্কার সেই সব অক্ষম দম্পতিকে চিকিৎসায় পথ দেখিয়েছে। রবার্ট এডওয়ার্ডসের আবিষ্কৃত পন্থা বিশ্বজুড়ে ওই সব মা-বাবাকে সন্তান উপহার দিচ্ছে। অনেক স্থানে দেখা যায় প্রতি পাঁচটি শিশুর মধ্যে একটি টেস্টটিউব বেবি। সহযোগী প্যাট্রিক স্টেপটোকে সাথে নিয়ে তিনি ক্যামব্রিজের বোর্ন হলে এ গবেষণা চালিয়েছিলেন। সেই প্যাট্রিক আজ আর বেঁচে নেই। তিনি ১৯৮৮ সালে মারা গেছেন। ওই বোর্ন হলেই প্রথম টেস্টটিউব বেবি লুইস ব্রাউনের জন্ম হয়েছে। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত ওই ল্যাবরেটরিতে জন্মেছে এক হাজারেরও বেশি টেস্টটিউব বেবি। এ ছাড়া এর মাধ্যমে এখন শুধু যুক্তরাজ্যেই প্রতিবছর ৯০০ শিশু জন্মগ্রহণ করছে।
ব্রিটিশ চিকিৎসক রবার্ট এডওয়ার্ডসের বর্তমান বয়স ৮৫ বছর। এখন বয়সের ভারে অনেকটাই নুয়ে পড়েছেন। তিনি পুরস্কারের কথা শুনে আনন্দ প্রকাশ করেছেন। পুরস্কার পাওয়ার পর রবার্ট এডওয়ার্ডস তার সহযোগী প্যাট্রিক স্টেপটোকে স্মরণ করেছেন। এডওয়ার্ডস বলেছেনÑ আমাদের তত্ত্ব আবিষ্কারের পর যখন সফল হয়েছিলাম তখন সারাক্ষণই প্যাট্রিক স্টেপটো শুধু হাসতেন।
সমালোচকদের দৃষ্টিতে এডওয়ার্ডস
টেস্টটিউব বেবির জনক রবার্ট এডওয়ার্ডসকে নোবেল পুরস্কার দেয়ায় ভ্যাটিকানের ‘পন্টিফিকল একাডেমি ফর লাইফ’-এর প্রধান কারাসকো দ্য পাওলো ইতালির সংবাদ সংস্থা এএনএসএ-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সমালোচনা করেন। পাওলো বলেছেন, এডওয়ার্ডসের কাজের কারণে অনেকে নতুন শিশুর মুখ দেখলেও তার কারণেই আজ মানব ভ্রƒণের বাজার সৃষ্টি হয়েছে। তার এ গবেষণা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্য দিকে নোবেল কমিটির তথ্যানুযায়ী কৃত্রিম প্রজনন নিয়ে এডওয়ার্ডসের গবেষণার কারণে পৃথিবীতে প্রায় ৪০ লাখ শিশুর জন্ম হয়েছে। আর সন্তান জন্মদানে অক্ষম দম্পতির চিকিৎসাও সম্ভব হয়েছে।
স্যার এডওয়ার্ডের এর শ্রদ্ধা জানিয়েছেন প্রথম টেস্টটিউব শিশু লুইস ব্রাউন। রবার্ট এডওয়ার্ড এবং তাঁর সহযোগী প্যাট্রিক স্টেপটোয়ের অবদান বিশ্বের লাখ লাখ মানুষের মুখে হাসি আর মনে শান্তি এনে দিয়েছে। এই দুজন মানুষের কল্যাণেই তাঁরা বাবা-মা হতে পারছে। স্যার এডওয়ার্ড বেঁচে থাকবেন বিশ্বজুড়ে যে অসংখ্য টেস্টটিউব শিশু জন্মাচ্ছে, তাদের মধ্যে।