হলিউডে নাফিসের অ্যানিমেশন দুনিয়া

(প্রযুক্তি প্রতিদিন) পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান মুভিটি অনেকেই দেখেছেন হয়তো। কিন্তু কেউ কি ভেবেছেন এই মুভিটিতে একজন বাঙালি তরুণের হাতের ছোঁয়া রয়েছে। শুধু ছোঁয়া নয়, এই মুভিতে অ্যানিমেশন কাজের জন্য যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশী সফটওয়্যার প্রকৌশলী নাফিস বিন জাফর ২০০৭ সালে সায়েন্টিফিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল বিভাগে বিশ্ব চলচ্চিত্রের নোবেল খ্যাত অস্কার (অ্যাকাডেমিক অ্যাওয়ার্ডস) জয় করেন।
বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান নাফিস ১৯৭৮ সালের ৮ অক্টোবর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা জাফর বিন বাশার নিউ ইয়র্কে একটি অ্যাকাউন্টিং ফার্মে কর্মরত। আর মা নাফিসা জাফর গৃহিণী। দাদাবাড়ি রাজবাড়ী জেলার কাজীকান্দা। নানাবাড়ি বিক্রমপুরের টঙ্গিবাড়ী থানার রামপারা। শৈশবে ইস্পাহানী পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে এবং এর পরে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে স্ট্যান্ডার্ড সিক্স শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। ১১ বছর বয়সে ১৯৮৯ সালে বাবার সাথে সপরিবারে আমেরিকার সাউথ ক্যারোলাইনার চার্লসটনে পাড়ি জামান। সেখানে কলেজ অব চার্লসটন থেকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর একটু ভিন্ন ধারার কিছু করার প্রয়াসে অ্যানিমেশন কাজকে কোডিংয়ে রূপান্তরের মাধ্যমে নান্দনিক শিল্পকর্ম নিয়ে অনুশীলন শুরু করেন। এরপর প্রজাপতি, পানি, ধোঁয়া আর প্রকৃতির অস্পর্শনীয় অনুভূতিকে ডিজিটাল ফরমেটে জীবন্ত করে তুলতে সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন নাফিস। বর্তমানে নাফিস লস অ্যাঞ্জেলেসভিত্তিক বিশ্বখ্যাত স্পেশাল ইফেক্টস ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান ড্রিম ওয়ার্কস অ্যানিমেশন-এর প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করছেন।
নাফিসের কাজের ক্ষেত্র
নাফিস জানান, বর্তমানে হলিউডে ভিজুয়াল ইফেক্টসে আমার একটা জায়গা তৈরি হয়েছে। নিজের প্রতি আস্থা ছিল, পুরস্কার জয়ের পর সেটা আরো দৃঢ় হয়েছে। কাজে উৎসাহ বেড়েছে। পরিসরও বেড়েছে। ২০০০ সালে ডিজিটাল ডোমেইন নামক প্রতিষ্ঠান দিয়ে আমার কাজের শুরু। আর বর্তমানে ড্রিম ওয়ার্ক অ্যানিমেশনে অ্যানিমেশনের পাশাপাশি সফটওয়্যার ডেভেলপের কাজও করছি।
নাফিস জানান, ‘অ্যানিমেশন হচ্ছে শিল্পের একটি ডিজিটাল মাধ্যম। রঙ-তুলির বদলে এখানে শিল্পী কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে তার দক্ষতা ফুটিয়ে তোলেন। প্রযুক্তিটি চিত্র পরিচালকদের ঝুঁকি, সময় ও কল্পিত দৃশ্যকে বিশ্বাসযোগ্য করে প্রদর্শনের দারুণ সুবিধা দেয়। তাই সেট নির্ভরতা কমিয়ে হলিউড এখন অনেকটাই ঝুঁকে পড়েছে ফ্লুইড অ্যানিমেশনের দিকে। সমুদ্রে না গিয়েই তারা দর্শককে দেখাতে পারছেন সমুদ্রে উথাল-পাথাল ঢেউ, কয়েক শ’ ফুট ওপরে উঠে পানি আছড়ে পড়ার সশব্দ দৃশ্য। তাই অ্যানিমেশনের কাজ করার সময় প্রথমেই মাথায় রাখতে হয়েছে কতটা সার্থকভাবে দৃশ্যটিকে জীবন্ত করে তোলা যায়। খুটিয়ে দেখেও যেন মনে না হয়, দৃশ্যটি কৃত্রিম। আর কৃত্রিম কাজটির জীবন্ত উপস্থাপনের জন্যই পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান : অ্যাট ওয়ার্ল্ডস ইন্ড ছবিতে যৌথভাবে অস্কার পেয়েছেন নাফিস।
এ পর্যন্ত শতাধিক মুভিতে কাজ করেছেন নাফিস। তিনি জানান, এর মধ্যে আমার সবচেয়ে বেশি হাতের ছোঁয়া রয়েছে কুং ফু পান্ডা২, ২০১২, পার্সি জ্যাকসন অ্যান্ড অলিম্পিয়ান্স : দ্য লাইটিং থিফ, দি সিকার : দি ডার্ক ইজ রাইজিং, শ্রেক ফর এভার আফটার, স্টিলথ, মেগামাইন্ড প্রভৃতি মুভিতে। ড্রিম ওয়ার্কসে আমি মূলত ফিচার অ্যানিমেশনে কাজ করছি। আমার চলমান কাজের মধ্যে চলতি বছর মুক্তি পেয়েছে টার্বো ও দ্য ক্রুডস। আগামী বছর আসছে মিস্টার পিবাডি অ্যান্ড শাম্যান। আগামী গ্রীষ্মে ব্লকবাস্টার মুভি হাউ টু ট্রেইন ইয়োর ড্রাগনের সিকুয়াল মুক্তি পাবে।
তরুণদের নিয়ে নাফিসের ভাবনা
অ্যানিমেশন হচ্ছে শিল্পের একটি ডিজিটাল মাধ্যম। রঙ-তুলির বদলে এখানে শিল্পী কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে তার দক্ষতা ফুটিয়ে তোলেন। ভালো প্রোগ্রামার যে কেউ হতে পারেন। তবে ভালো অ্যানিমেটর হতে হলে শিল্পমন থাকাটা জরুরি। এখানে প্রোগ্রামার তার কল্পনাটাকে ভিজুয়ালাইজেশন করবেন। এ ক্ষেত্রে সহজাত প্রতিভা যাদের আছে তারা নিঃসন্দেহে ভালো করবে। তবে কাজের প্রতি সিনসিয়ারিটি ও ভালোবাসা থাকলে আমার মনে হয়, যে কেউ অ্যানিমেটর হিসেবে সফল হতে পারে।
আমি কোনো কাজ কখনো পুরস্কার পাওয়ার জন্য করিনি। পুরস্কার পাওয়ার কথা জেনেও কেন জানি খুব বেশি উৎফুল্ল হইনি। তবে যখন পুরস্কারটা পেয়েছি, আমার বাবা-মা, আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই খুবই খুশি হয়েছেন। তাদের জন্যই আমার কাছে পরে মনে হয়েছে না, আমি বোধ হয় বড় কিছুই অর্জন করতে পেরেছি।
নতুনদের এই সেক্টরে কাজ করার জন্য সবচেয়ে আগে দরকার কল্পনাপ্রবণ মন ও নিবিড় অনুভূতি। একাগ্রতা আর নিষ্ঠা। আর এর পাশাপাশি চর্চার কোনো বিকল্প নেই। প্রচুর প্রজেক্ট করতে হবে। লেগে থাকলে সফলতা আসবেই। সৃষ্টির মধ্যে যিনি আনন্দ খুঁজে পান, তাদের জন্য এটা খুব কঠিন কিছু নয়।
অনুপ্রেরণার উৎস
নাফিসের মা খুবই ভালো আর্ট করেন। যদিও তিনি পেশাগত শিল্পী নন। নাফিস জানান, আমি সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছি মাকে দেখে। ছোটবেলা থেকেই মায়ের কাজ দেখছি। মুগ্ধ হয়েছি। মার কাছ থেকেই আমার ভেতরে এ শিল্পটা বেড়ে উঠেছে। তবে বাবাও আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন। আমার মামা সৈয়দ মইনুল হোসেন জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি। নাফিস জানান, আমাদের পুরো পরিবারটা যদি লক্ষ করেন, দেখবেন সবাই মোটামুটি আঁকাআঁকিতে পটু। ছোটবেলা থেকেই তাদের কাজ দেখে আসছি। আমাকে চিত্রশিল্পী হতে হবে কিংবা মামার মতো প্রখ্যাত স্থপতি হতে হবে, এমন ভাবনা কখনো মাথায় আসেনি। তবে সব সময় তাদের কাজ দেখতে দেখতে হয়তো অবচেতনভাবেই তারা আমার ভেতরে জায়গা করে নিয়েছেন। আমাকে প্রভাবিত করেছেন। আর সেখান থেকেই আজকের নাফিস একজন সফল অ্যানিমেটর।
বয়স ত্রিশের কোঠা পার হলেও নাফিস বিন জাফর এখনো শিশুর মতোই আচরণ করে বলে জানালেন তার মা নাফিসা জাফর। তার ভাষায়, ‘ও একটু লাজুক স্বভাবের মনে হলেও খুবই মিশুক। ওর বন্ধুরাও ওকে খ্বুই পছন্দ করে। এখনো প্রতি সপ্তাহেই ছুটিতে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে নিউ ইয়র্কে এসে আমাদের সাথে সময় কাটায়।
দেশী মুভির প্রেক্ষাপট
পেশাগত কারণে নাফিস প্রচুর হলিউডের মুভি দেখেছেন। আর বাংলা মুভির ক্ষেত্রে তিনি ছোটবেলা থেকেই সত্যজিৎ রায়ের ভীষণ ভক্ত তিনি। সাদা-কালো যুগে তার ছবির ফ্রেম, লোকেশন, প্রপোস দেখে এখনো মুগ্ধ হন নাফিস। তবে বাংলাদেশের সমসাময়িক সময়ের সিনেমা দেখা হয় না নাফিসের। তিনি বলেন, একটি শর্ট অ্যানিমেশন সিনেমা দেখেছিলাম, বাংলা। নামটা মনে করতে পারছি না। বেভারলি হিলস ফিল্ম উৎসবে মুভিটি প্রদর্শিত হয়। খুবই চমৎকার ছিল। বাংলা সিনেমায় অ্যানিমেশনের ব্যবহার তেমন লক্ষ করা যায় না। যদিও সর্বশেষ কয়েকটি সিনেমায় স্বল্প পরিসরে হলেও অ্যানিমেশন ব্যবহার লক্ষ করা গেছে। আমি সরাসরি সিনেমার মানুষ না হয়েও যতটুকু বুঝি আমাদের দেশের নির্মাতাদের নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের আগ্রহ এবং নতুন কিছু করে দেখানোর সৃজনশীল মানসিকতা কম। নাফিস জানান, আপনি যদি জেমস ক্যামেরন কিংবা স্টিফেন স্পিলবার্গের কথা চিন্তা করেন দেখবেন, তারা প্রতিটি মুভিতে নিজেদের ভাঙছেন। জেমস ক্যামেরনের অ্যাভাটার দেখেন। অ্যানিমেশনের কী জাদুকরী ব্যবহার! অ্যাভাটারের চরিত্রগুলোর আইডিয়া কিন্তু ক্যামেরনের মস্তিষ্কপ্রসূত। তার ইমাজিনেশনটাই অ্যানিমেটররা বাস্তবায়ন করেছেন। আমি সিনেমার মানুষ না হলেও আমার এটিই মনে হয়, নতুন ভাবনা এবং সৃজনশীল মানসিকতা সিনেমার প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রত্যেক নির্মাতাই প্রথমে সেলফ সেটিসফিকশনের কথা চিন্তা করেন। এরপর দর্শক। আমার মনে হয়, যাদের জন্য সিনেমাটি বানানো তারা যদি দেখতে আগ্রহী হন, নির্মাতার জন্য সেটিই বড় পুরস্কার। আর অস্কার পায়নি বলে, হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমাদের দেশের তরুণরা অনেক প্রতিভাবান। হয়তো আগামী দিনে কোনো একদিন এ দেশের সিনেমা অস্কার জিতবে।
আপাতত দেশের কোনো মুভিতে কাজ করার ইচ্ছা নাই নাফিসের। কারণ নাফিস যে ধরনের কাজ করেন, তার জন্য যে সেটআপ লাগে, তাতে অনেক খরচ। এ ছাড়া নানা কাজে ভীষণ ব্যস্ততা রয়েছে নাফিসের।
অ্যানিমেশনের প্রতি আগ্রহ
পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান মুভিতে ফ্লুইড ইফেক্ট ব্যবহার ছিল একটু ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা জানালেন নাফিস। এখন তো বড় পরিসরে ফ্লুইড ওয়ার্ক চলছে। আমার ব্যক্তিগত দুর্বলতা রয়েছে ডিস্ট্রাক্সন, ফ্রিকশ্চার, স্যাটায়ার ও সলিড অবজেক্ট নিয়ে। আশা করছি, ফটোরিয়েল রেন্ডারিং ও নিউ অ্যালগারিদম নিয়ে মজার কিছু ইফেক্ট উপহার দিতে পারব।
নাফিস ক্লাসিক অ্যানিমেশন পছন্দ করেন। ডিজনি বা মিকিমাউস টাইপের অ্যানিমেশনসহ ফ্যান পেজা মুভির অ্যানিমেশন নাফিসকে মুগ্ধ করেছে। ম্যানি অব দ্য বাক বানি থেকেই নাফিসের অ্যানিমেশনের প্রতি আগ্রহের শুরু।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ভবিষ্যতে একজন প্রকৃত শিল্পী হয়ে বেঁচে থাকতে চান নাফিস বিন জাফর। আরো নিখুঁত ও নান্দনিকভাবে নিজের কাজকে ফুটিয়ে তুলতে চান। অন্য কোনো কাজে জড়ানোর আগ্রহ নেই। নাফিসের ভাষায়, ‘ব্যবসায় অনেক কঠিন কাজ। আমি শিল্পী হয়েই কাজ করতে চাই।’