ব্রেইন পিকিংস এর উদ্ভাবক মারিয়া পোপোভা

(প্রযুক্তি প্রতিদিন) বইয়ের পোকা হয়েও নিজে কখনো বই লিখবেন না বলে ঠিক করেছেন মারিয়া পোপোভা। ইন্টারনেটের জ্ঞান সম্রাজ্যের উদীয়মান নক্ষত্র হয়েও তার সঠিক পরিচয় জানেন না কেউই। বয়স মাত্র ২৮ বছর, কিন্তু অতীত, বর্তমানের বিপুল জ্ঞান তার নখদর্পণে। মারিয়ার সাম্রাজ্যের নাম ব্রেইন পিকিংস। ফাস্টকোম্পানি নামক একটি অনলাইন জরিপে ২০১২ সালের অন্যতম সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব হিসেবে উঠে এসেছিল মারিয়ার নাম।

কোন কিছুরই অভাব নেই মারিয়ার জ্ঞানের ঝুলিতে। বিজ্ঞানের চমকপ্রদ তত্ত্ব, ফটোগ্রাফ, প্রেমপত্র, যখন-তখন টুকে রাখা নোট থেকে মারিয়া উদ্ভাবন করেন শিক্ষণীয় কিছু। আর এজন্য তার ব্লগসাইট ব্রেইন পিকিংস এর মাসিক পাঠক ৫ লাখ, নিউজলেটার গ্রাহক দেড় লাখ, টুইটারে অনুসরণকারী ২ লাখ ৬৩ হাজার। টুইটারের দুই প্রতিষ্ঠাতা বিজ স্টোন ও ইভান উইলিয়ামস বিখ্যাত ঔপন্যাসিক উইলিয়াম গিবসন থেকে শুরু করে হলিউড অভিনেত্রী মিয়া ফ্যারোর মত ক্ষ্যাতিমান ব্যাক্তি রয়েছে মারিয়ার অনুসরণকারীদের তালিকায়।

অন্যান্য ইন্টারনেট সেলিব্রেটিদের চেয়ে অনেকটা নিভৃতেই বিচরণ করেন মারিয়া পোপোভা। যার ফলে তার নাম-পরিচয় তেমন কিছুই জানেন না ভক্তরা। তার প্রোফাইলে খুঁজে পাওয়া যাবে না কোনো ব্যক্তিগত তথ্য; এমনকি নিজের কোনো ছবিও ব্যবহার করেননি কখনো। তার বয়সে যেখানে অন্য সবাই নিজেদের নিয়ে, লঘু আড্ডা-গল্প নিয়ে টুইট করতে ব্যস্ত থাকেন, সেখানে মারিয়ার টুইটে ‘আমি’ শব্দটি খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর।

মারিয়া বলেন, আমি যেসব ব্যাপারে মানুষকে আগ্রহী করে তুলি, সেসব ব্যাপার জানার আগে তারা নিজেরাও জানতো না যে তারা ঐ ব্যাপারে আগ্রহী। মারিয়ার টুইটার প্রোফাইল কিংবা ওয়েবসাইটে (www.brainpickings.org) এ কথার সত্যতা পাওয়া যাবে। দর্শন, বিজ্ঞান, সমাজ, চিত্রকলা, সাহিত্য হেন বিষয় নেই যা তার ভাণ্ডারে খুঁজে পাওয়া যাবে না। পৃথিবীতে আপনার প্রিয় বিষয়টিরও কতো আকর্ষণীয়, চমকপ্রদ তথ্য যে আপনি জানতেন না, তা ভেবে নিজেই অবাক হবেন। মানুষের সামনে ওভাবে নিজেকে প্রদর্শন করার কোনো প্রয়োজন বোধ করি না। আমি নিজেকে একজন ব্যক্তি না ভেবে একটি সংগঠন ভাবতে পছন্দ করি। আমার প্রতিটি দিনই কাটে দারুণ ব্যস্ততার মধ্যে। কাজ করার সময় বসে থাকার চেষ্টা করি, কিন্তু তাতে আমার মন সবখানে ছুটে বেড়াতে থাকে। শরীর যখন নড়াচড়ার মধ্যে থাকে, শুধু তখনই ছুটে বেড়ানো মনকে কিছুটা কেন্দ্রীভূত করতে পারি।

অনুপ্রেরণা
মারিয়ার বাবা ছিলেন প্রকৌশলের ছাত্র, যিনি পরবর্তীতে অ্যাপলে চাকুরি করেন। মা পড়াশোনা করেছেন লাইব্রেরি সায়েন্সে। বাবা-মার ব্যাপারে মারিয়া জানালেন, “আমাদের তেমন যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু কিছুদিন আগেই আমরা স্কাইপেতে কথা বলেছি। এরপর লাইব্রেরি সায়েন্সের ব্যাপারটা আমার মাথায় ঢুকে গেছে। আমি বুঝতে পেরেছি, আমি এতোদিন যা করেছি তাকে অনলাইন জগতের লাইব্রেরিতে বই সাজানোর একটি পদ্ধতি বলা যায়। আমার কাজ দেখে শুরুতে খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন মা।
মারিয়ার দাদি ছিলেন জ্ঞানের পাগল। তার কাছে প্রচুর এনসাইক্লোপিডিয়া ছিল, যেগুলোকে মারিয়া তার জ্ঞানের পেছনে ছোটার মূল প্রেরণা মনে করেন। পাশাপাশি বর্তমানে ইন্টারনেটে প্রচলিত পদ্ধতি নয়, বরং এনসাইক্লোপিডিয়া থেকে খুঁজে খুঁজে জ্ঞান অর্জন করাকেই শেখার আসল পদ্ধতি মনে করেন তিনি।

শিক্ষা জীবন
বুলগেরিয়ার একটি আমেরিকান হাই স্কুল থেকে স্নাতক পাশ করার পর ২০০৫ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেনিয়ায় ভর্তি হন। সেখানে পড়াশোনার ধরন, বড় বড় লেকচারে দ্রুত বিরক্ত হয়ে পড়েন মারিয়া। সেসময় একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থাতেও পার্ট-টাইম চাকরি করতেন তিনি। সেখানেই প্রথমবারের মতো সহকর্মীদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য বিভিন্ন মজার ও দুর্লভ তথ্য জানিয়ে ই-মেইল করতেন তিনি। তখন কিছু না ভেবেই এর নাম দিয়েছিলেন ‘ব্রেইন পিকিংস’।
মারিয়ার এসব মেইল সহকর্মীদের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয় হতে থাকে। সেগুলো একত্রিত করে রাখার জন্য একটি দায়সারা ওয়েবসাইট তৈরি করলেন তিনি। পড়াশোনা, বিজ্ঞাপনের কাজ, বিভিন্ন ম্যাগাজিনে আর্টিকেল লেখার পাশাপাশি ওয়েবসাইটেও নিয়মিত তথ্য যোগ হতে লাগলো।
জ্ঞান আর কৌতূহলের সা¤্রাজ্য ব্রেইন পিকিংস আজ জনপ্রিয়তার শীর্ষে। কয়েক লাখ মানুষের কৌতূহল আর জ্ঞানের এই ভাণ্ডার থেকে আয়ও করছেন মারিয়া। তবে ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচুর অর্থ কামানোর সুযোগ থাকলেও কখনোই বিজ্ঞাপন দেন না। বরং উন্মুক্তভাবে সাহায্য চান তার গ্রাহক, পাঠকদের কাছে। পাশাপাশি আমাজন.কম থেকে তার পরামর্শে যেসব বই কেনেন ক্রেতারা, সেখান থেকে একটি অংশ পান তিনি। এই উপার্জনই নিজের জন্য, যা করতে চান তার জন্য যথেষ্ট মনে করেন মারিয়া।

ব্রেইন পিকিংস (www.brainpickings.org)
মারিয়ার নিজ হাতে গড়ে তোলা ব্রেইনপিকিংসের পেছনে মাসে ৪৫০ ঘণ্টারও বেশি, অর্থাৎ দিনে গড়ে প্রায় ১৮ ঘণ্টার মতো সময় দেন মারিয়া। প্রতিদিন পড়তে হয় শত আর্টিকেল, ঘাঁটতে হয় পুরনো বই থেকে শুরু করে আধুনিক ভিডিওচিত্র।
ব্রেইন পিকিংসের সাফল্যের পেছনে আধুনিক মানুষের বাণিজ্যিক মনোভাবেরও কৃতিত্ব রয়েছে বলে মনে করেন মারিয়া। আজকের দিনে মানুষ যেমন সহজেই সব পণ্য ঝামেলাবিহীনভাবে পেতে চায়, মারিয়াও তাই করেন। জানা-অজানা অনেক জটিল, ধোঁয়াটে, অদ্ভুত, রহস্যময় বিষয়কে সাধারণ মানুষের বোঝার উপযোগী ‘প্যাকেজ’-এ পরিণত করেন তিনি। আরও নিখুঁতভাবে বললে, ধরা-ছোঁয়ার বাইরের বিষয়গুলোকে ‘মধ্যবিত্তের উপযোগী’ করে গড়ে তোলেন মারিয়া। তিনিই সেরা কিউরেটর, যার স্বাদ লাখ লাখ মানুষের স্বাদের সঙ্গে মিলে যায়। আমার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছে।
মারিয়ার কাজগুলো এতো জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে আরেক কারণ, তার লেখাগুলো নিছক নিস্প্রাণ কোন ফিচার নয়। প্রতিটি লেখাতেই রয়েছে তার চমৎকার লেখন ভঙ্গী, আকর্ষণীয় গ্রাফিক্স, প্রয়োজনীয় ফটোগ্রাফ ও বিভিন্ন ধরনের হাতে আঁকা ছবি। ভক্তদের মতে, মারিয়ার প্রতিটি লেখায় এমন একটা আকর্ষণী ক্ষমতা আছে, যার ফলে সেগুলো আর লেখা থাকে না, জীবন্ত অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে।

মারিয়ার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
মারিয়া বলেন, আমি নিজেকেই সবসময় প্রশ্ন করি, এর শেষ কোথায়? এরপর কি? এর উত্তর : আমি যা করছি তা-ই করবো, এবং এর কখনো পরিবর্তন হবে না বলে আমি বিশ্বাস করি।
তবে ইন্টারনেটকেই এ যুগের জ্ঞান আর কৌতূহলের আসল চাবিকাঠি মনে করেন তিনি। ইন্টারনেটের বিপুল বিস্ময়ের অনেকটুকুই এখনো বাকি বলে মনে করেন। ব্রেইন পিকিংসকে ২১ শতকের নতুন ধারণার লাইব্রেরির রূপ দিতে চান তিনি। ইন্টারনেটের প্রচলিত পদ্ধতির মতো নয়, বরং সেই শিশুকালে দাদির এনসাইক্লোপিডিয়া ও মায়ের লাইব্রেরি সায়েন্স থেকে জ্ঞানার্জনের যে প্রকৃত রূপ খুঁজে পেয়েছিলেন, সেটাই ছড়িয়ে দিতে চান সবার মধ্যে। জ্ঞানকে জ্ঞানের মতোই যথাযথ মর্যাদায় দেখতে চান। শুধু স্ট্যাটাস আপডেট কিংবা একটি ব্লগ পোস্ট হিসেবে নয়। ইতোমধ্যেই তিনি তার স্বপ্নের পথে অনেকদূর অগ্রসর হয়েছেন তিনি। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, গত দশকে যেমন ফেসবুক, টুইটার, উইকিপিডিয়া, ইউটিউবের মতো জাদু আমাদের জীবনযাত্রাকে বদলে দিয়েছে, তেমনি চলতি দশকের শুরুতে ব্রেইন পিকিংস হয়তো আরো নতুন কোনো লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।