আহমেদ ইফতেখার
সময়ের সাথে সাথে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। আমাদের দেশ এবং আমাদের বাংলা ভাষাও বর্তমানে পিছিয়ে নেই। কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, স্মার্টফোনসহ বিভিন্ন ডিভাইসে বাংলা ভাষার ব্যবহার বেড়েই চলেছে। অনলাইন দুনিয়ায়ও বাংলার ব্যবহার বাড়ছে।
শুরুতে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার দুরূহ হলেও বর্তমানে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের সাথে সাথে বাংলার ব্যবহার সহজতর হচ্ছে। ১৯৮৩ সালে সাইফুদ্দোজা শহীদ ম্যাক সিস্টেমের জন্য ফন্ট এবং কিবোর্ড ডিজাইনের কাজ শুরু করেন। ১৯৮৪ সালে অ্যাপলের রিসোর্স এডিটরের সহায়তায় বিটম্যাপনির্ভর ফন্টে তিনি তৈরি করেন ‘শহীদলিপি’। এটিকে কম্পিউটারের প্রথম বাংলা ফন্ট ধরা হয়। এর ধারাবাহিকতায় ম্যাকিন্টোশের জন্য ‘বঙ্কিম’ নামক প্রথম বাংলা লেজার ফন্ট তৈরি করে কলকাতার রাহুল কমার্স প্রতিষ্ঠান। তবে কলকাতায় তৈরি হলেও এ ফন্টটি তৈরি করেছিলেন বাংলাদেশের সন্তান গৌতম সেন। এটি দিয়ে আনন্দপত্র নামে একটি প্রকাশনাও বের হয়। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত কম্পিউটারে বাংলা লেখার জন্য কোনো ইনপুট সফটওয়্যার ছিল না। ফলে কম্পিউটারে বাংলা টাইপ করার সুবিধা থাকলেও টাইপিং ছিল অত্যন্ত ধীরগতির। এ সমস্যার সমাধান প্রথমবারের মতো সমাধান নিয়ে আসেন প্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার। তিনি ‘বিজয়’ নামে তিনি নিয়ে আসেন প্রথম বাংলা ইনপুট সফটওয়্যার। ১৯৮৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু হয় বিজয়। ম্যাক দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও পরবর্তীকালে আইবিএমের ব্যবহার শুরু হয়ে গেলে আইবিএম পিসির জন্যও তৈরি হয় বাংলা সফটওয়্যার। ১৯৯২ সালে প্রথম তৈরি হয় ‘বর্ণ’ নামের একটি ওয়ার্ড প্রসেসিং সফটওয়্যার। ১৯৯৩ সালে ‘বিজয়’ও আসে আইবিএম-এর জন্য।
সাধারণত কম্পিউটারে কোনো সফটওয়্যারে বাংলা লিখলে তা অন্য কম্পিউটারে নিয়ে গেলে ফন্টটি যদি ওই পিসিতে ইন্সটল করা না থাকে তাহলে পড়তে পারে না। এই ঝামেলা থেকে মুক্তি দিতে আসে ইউনিকোড। এটি এমন একটি পদ্ধতি, যার ব্যবহার যেকোনো কম্পিউটারের কাছে তাকে পরিচিত করে তুলতে পারে। ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম নামে একটি অলাভজনক সংস্থা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার জন্য ইউনিকোড অনুমোদন করে থাকে। প্রতিটি ভাষার প্রতিটি অরের জন্য তারা বরাদ্দ করে থাকে একটি নির্দিষ্ট কোড। যে কম্পিউটার ইউনিকোড সমর্থন করে, সেই কম্পিউটারে ইউনিকোডে যেকোনো ভাষায় লেখা যেকোনো কিছুই পড়া যায়। ইউনিকোডের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, বর্তমানের প্রায় সব ধরনের অপারেটিং সিস্টেমই ইউনিকোড সমর্থন করে থাকে। শুধু তা-ই নয়, অপারেটিং সিস্টেমের বাইরে ওয়েব ব্রাউজারগুলোও এখন ইউনিকোড সমর্থন করে থাকে। ২০০০ সালের পর থেকেই বাংলা ইউনিকোড সফটওয়্যার এবং ফন্ট তৈরি নিয়ে কাজ করছেন আগ্রহীরা। সফলভাবে প্রথম ইউনিকোড বাংলা সফটওয়্যারটি তৈরি করতে সমর্থ হয় ওমিক্রন ল্যাব। তাদের তৈরি সফটওয়্যারটির নাম ছিল ‘অভ্র’। প্রায় সব ধরনের ওয়েব ব্রাউজারে ব্যবহারের সুবিধা থাকায় এটি দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করতে শুরু করে।
বাংলায় তথ্যপ্রযুক্তিতে অগ্রগতি
অনেক দিন পর হলেও শেষ পর্যন্ত সরকারি উদ্যোগে তৈরি হয়েছে বাংলা ইউনিকোড ফন্ট। সরকারের প থেকে এর আগে নির্বাচন কমিশন একটি ফন্ট তৈরি করলেও তাতে কিছু কিছু বিষয়ে কিছু সমস্যা ছিল। এসব সমস্যা দূর করে পূর্ণাঙ্গ একটি ফন্ট তৈরি করতেই গত বছরের শেষের দিকে সরকার এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। মূলত বাংলা একাডেমীর নেতৃত্বে এই ফন্ট তৈরির কাজ শুরু হয়। এর পেছনে আর্থিক সহায়তা দেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই)। আর এতে কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিক্স ডিজাইন বিভাগ। সরকারি উদ্যোগে তৈরি বাংলা ইউনিকোড ফন্টের নাম দেয়া হয়েছে ‘আমার বর্ণমালা’। এতে থাকবে তিন ধরনের ফন্ট। এর প্রথম দুইটি তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের দাফতরিক কাজে ব্যবহারের জন্য। অন্য দিকে তৃতীয় ফন্টটি তৈরি করা হচ্ছে হাতের লেখার আদলে। ‘আমার বর্ণমালা’ ফন্ট তৈরি থেকে যাবতীয় কার্যক্রমের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক ড. শামসুজ্জামান খান এবং ফন্ট বিশেষজ্ঞ জামিল চৌধুরী। আমার বর্ণমালার তৃতীয় ফন্টটি তৈরিতে আপনার হাতের লেখার একটি বাক্য বা একটি শব্দ বা একটি বর্ণ আপনি স্ক্যান করে আপলোড করে দিতে পারেন আমার বর্ণমালার নিজস্ব ওয়েবসাইটে (www.ama rbor nomala.gov.bd)। এখানে যেসব হাতের লেখা জমা পড়বে, সেগুলোর মধ্য থেকে বিচারকেরা নির্বাচন করবেন ফন্ট তৈরির জন্য ডিজাইন।
বাংলায় বিজয় অ্যান্ড্রয়েড
সময়ের সাথে সাথে কম্পিউটার আর ল্যাপটপের পাশাপাশি ট্যাবলেট পিসি আর স্মার্টফোনের ব্যবহার বাড়ছে। ফলে স্মার্টফোন বা ট্যাবলেট পিসিতেও বাংলা লেখার সুবিধা নিশ্চিত করতে কাজ করছে বিজয়। কম্পিউটারে বাংলা লেখার জনপ্রিয় সফটওয়্যার ‘বিজয়’-এরও অ্যান্ড্রয়েড সংস্করণ বাজারে এসেছে। ভাষার এই মাসে এসেছে বহুল ব্যবহৃত বিজয়ের অ্যান্ড্রয়েড সংস্করণ। শুরুতে তাই অ্যান্ড্রয়েড নির্ভর ডিভাইসের জন্য বাংলা ইনপুট সফটওয়্যার ও ফন্ট তৈরি করছে। অভ্র অবশ্য ইতোমধ্যেই অ্যান্ড্রয়েড এবং অ্যাপলের আইওএসের জন্য তাদের সফটওয়্যারের নিজস্ব সংস্করণ তৈরি করেছে। গত ২১ ফেব্র“য়ারি থেকেই অ্যান্ড্রয়েডের জন্য বিজয়ের অনলাইন সংস্করণ ব্যবহার করতে পারছেন আগ্রহীরা।
বাংলায় ওপেন সোর্স
দেশে অনেক দিন আগে থেকেই এর চর্চা শুরু হয়েছে। অঙ্কুরের লিনাক্সভিত্তিক শ্রাবন্তি অপারেটিং সিস্টেম এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেমে বাংলা সংযোজন আমাদের একটি বিরাট অর্জন। তা ছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যলয় ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তাদের কাজের মাধ্যমে এ কাজে আমাদের আশার সঞ্চার করেছে। আর যাকে অবশ্য ধন্যবাদ দিতে হয় তা হলো অভ্র কিবোর্ড। ইউনিকোডভিত্তিক বাংলা লেখার এক অসাধারণ সফ্টওয়্যার এটি। বাংলা কম্পিউটিংয়ের প্রসারের জন্য আমাদের আরো অনেক দূর যেতে হবে। তাই এখন সময় এসেছে নিজেদের জাগ্রত করার। ওপেন সোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিজেদের তৈরি করতে হবে নতুন বাংলার যুগের জন্য।
বাংলায় মোবাইলফোনে এসএমএস সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের যোগাযোগের ভাষাটি তথ্যপ্রযুক্তিতে ব্যবহারের সুযোগ ছিল না বলেই এত দিন মানুষ ইংরেজি ব্যবহারে বাধ্য হয়েছে। মোবাইল ফোনে খুদেবার্তা আদান-প্রদানে এখন ইংরেজি হরফের পাশাপাশি বাংলা হরফ ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।
বাংলায় আমাদের ব্যর্থতা
দেশের বেশির ভাগ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ইংরেজি ভাষার আধিক্য রয়েছে। যেহেতু বাংলা ভাষার জন্য আত্মত্যাগের ঘটনাটিকে পুরো বিশ্ববাসীর কাছে স্মরণীয় করতে ১৯৯৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ থেকে জাতিসঙ্ঘে একটি আনুষ্ঠানিক চিঠির মাধ্যমে ২১ ফেব্র“য়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব করা হয়। সেই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই প্যারিসে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ সভায় ভাষার জন্য এই আত্মত্যাগের ঘটনাটিকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয় এবং ২১ ফেব্র“য়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এর ফলে পরের বছর থেকে বিশ্বের ১৮৮টি দেশ একযোগে ২১ ফেব্র“য়ারি দিনটিকে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে থাকে। কিন্তু দেশেই এখন তথ্যপ্রযুক্তির সব েেত্র বাংলার প্রচলন শুরু হয়নি। ইতোমধ্যে অনেক বাংলা ব্লগ চালু হয়েছে, উইকিপিডিয়া, গুগল ইত্যাদির বাংলা সংস্করণও বিকশিত হচ্ছে, ফেসবুকেও বাংলায় যোগাযোগ চলছে; কিন্তু ব্যবসায়-বাণিজ্য, ব্যাংকিং, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ইত্যাদি খাতে বাংলা ভাষার প্রচলন ঘটেনি। এজন্য প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি উভয়পর্যায়ের জোরালো উদ্যোগ এবং বিশেষত জরুরি প্রযুক্তিবিদ, উদ্ভাবক, সফটওয়্যার-প্রণেতা এবং এই খাতের ব্যবসায়ী মহলের আন্তরিক তৎপরতা।
আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সুযোগ-সুবিধাগুলো গ্রহণ করে বিশ্বের যেসব দেশ দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তারা মূলত মাতৃভাষাই ব্যবহার করছে। জাপান, রাশিয়া, জার্মানি, সুইডেন, ফ্রান্স প্রভৃতি উন্নত জাতি তো বটেই, এমনকি আমাদের প্রতিবেশী চীন, থাইল্যান্ডের মানুষও তথ্যপ্রযুক্তিকে মাতৃভাষায় ব্যবহারের উপযোগী করে নিয়েছে এবং তারা শুধু মুঠোফোনের মধ্যেই মাতৃভাষার ব্যবহার সীমাবদ্ধ রাখেনি, ইন্টারনেটেও ছড়িয়ে দিয়েছে। আমাদেরও সেই পথে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন।